ক্রোমিক এসিড কী? কোন কোন কাজে ক্রোমিক এসিডের ব্যবহার হয়

ডাইক্রোমেট এর সাথে ঘনীভূত সালফিউরিক এসিড যোগ করে তৈরি মিশ্রণ হচ্ছে ক্রোমিক এসিড। এর রাসায়নিক সংকেত H2CrO. এর রঙ গাড় স্ফটিক বর্ণের। ক্রোমিক এসিড সাধারণত গন্ধহীন ও বালির মতো কঠিন। ক্রোমিক এসিডের মধ্যে কঠিন ক্রোমিয়াম ট্রাই অক্সাইড সহ বিভিন্ন ধরনের যৌগ থাকতে পারে। এই ধরনের ক্রোমিক এসিড কাচ পরিষ্কারের জন্য মিশ্রণ হিসাবে ব্যবহার করা হয়। ক্রোমিক এসিড একটি শক্তিশালী এবং ক্ষয়কারী জারক দ্রব্য। এর অনুবন্ধী ক্ষারক হচ্ছে ক্রোমেট এবং ডাই ক্রোমেট। আণবিক ক্রোমিক এসিডের অ্যানহাইড্রাইড হচ্ছে ক্রোমিয়াম ট্রাই অক্সাইড, যা লুইস এসিড এবং লুইস বেসের সাথে বিক্রিয়া করতে পারে। ক্রোমিক এসিডের সাথে সালফিউরিক এসিডের অনেক মিল রয়েছে। ১৯৪০ এর দশকে মেলেরিওন নামে চুল রঙ করার ডাই তে ক্রোমিক এসিড ব্যবহার করা হত। তবে বর্তমানে ক্রোমিক এসিডকে সাধারণত বিপদজনক ও বিষাক্ত হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে।


রাসায়নিক কারখানা ও পরীক্ষাগারে ক্রোমিক এসিডের ব্যবহার

সালফিউরিক এসিড ও ক্রোমিক এসিডের একটি দ্রবণ সালফোক্রোমিক মিশ্রণ বা ক্রোমোসালফিউরিক এসিড, যা একটি শক্তিশালী জারক দ্রব্য হিসাবে পরীক্ষাগার কাচপাত্র পরিষ্কার করতে, বিশেষ করে কোন বিক্রিয়া বা পরীক্ষা শেষে অদ্রাব্য জৈব অবশেষ পরিষ্কার করতে ব্যবহার করা হয়। পরিবেশগত উদ্বেগের আশংকার কথা মাথায় রেখে এই ব্যবহার বর্তমানে কমিয়ে আনা হয়েছে । এছাড়াও ক্রোমিক এসিড প্যারাম্যাগনেটিক ক্রোমিক আয়ন এর পরিমাণ চিহ্নিত করতে এনএমআর বর্ণালীর মতো ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়। ক্রোমিক এসিড অনেক ধরনের জৈব যৌগকে অক্সিডাইজ করতে সক্ষম। ক্রোমিক এসিডকে জলীয় সালফিউরিক এসিড এবং অ্যাসিটোনে জোন্স বিকারক হিসাবে উল্লেখ করা হয়।


শিল্প কারখানায় ক্রোমিক এসিডের ব্যবহার

কাচ ও কাচের তৈরি জিনিসপত্র, তৈজসপত্র ইত্যাদি বানানোর কারখানায় বানিজ্যিক ভাবে ক্রোমিক এসিড ব্যবহার করা হয়। বিশেষ করে কাচে ক্রোমিয়াম প্লেটিং, কাচের তৈজসপত্রে সিরামিক গ্লেজ দিয়ে চকচকে করতে ক্রোমিক এসিড ব্যবহার করা হয়। স্বচ্ছ কাচে থেকে রঙিন কাচ তৈরি করতেও ক্রোমিক এসিডের ব্যবহার আবশ্যক। পিতল বা তামাকে উজ্জ্বল করার ক্ষমতা থাকার কারনে ক্রোমিক এসিড ব্যাপকভাবে বাদ্যযন্ত্র মেরামত কারখানা গুলোয় ব্যবহৃত হয়। এলুমিনিয়ামের উপর মেটাল কোটিং করার জন্যও বিভিন্ন কারখানায় ক্রোমিক এসিড ব্যবহার করা হয়ে থাকে। তবে ক্রমবর্ধমান স্বাস্থ্য এবং পরিবেশগত উদ্বেগের কারণে, সচেতনতা বৃদ্ধির সাথে, অনেক কারখানা ও মেরামতের দোকানে এই রাসায়নিকের ব্যবহার বন্ধ করে দেয়া হয়েছে বর্তমানে। ছবি প্রিন্ট করার দোকান বা কারখানা গুলোতেও ক্রোমিক এসিডের ব্যবহার রয়েছে । ছবি প্রিন্টের প্রক্রিয়ায় ফিল্ম থেকে রিভার্স করে ব্লিচ করতে ক্রোমিক এসিড ব্যবহার করা হয়। ট্যানারি বা চামড়া শিল্পে কাচা চামড়া প্রক্রিয়াজাত করে ব্যবহার উপযোগী ল্যাদারে পরিনত করার প্রক্রিয়ায় একটি ধাপ হচ্ছে ট্যানিং। এই ট্যানিং করতে বিভিন্ন রাসায়নিক উপাদানের মধ্যে ক্রোমিক এসিড অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ। ব্যাটারি, আঠা ইত্যাদি তৈরিতেও রয়েছে ক্রোমিক এসিডের ব্যবহার।


চিকিৎসা ক্ষেত্রে ক্রোমিক এসিডের ব্যবহার

চিকিৎসা ক্ষেত্রে ক্রোমিক এসিডের বহুক আকারে ব্যবহার না থাকলেও কিছু কিছু জীবানু নাশক এন্টিসেপ্টিক ওষুধ বা মলম তৈরীতে এটি একটি উপাদান হিসেবে ব্যবহার করা হয়। ক্রোমিক এসিড ব্যবহার করা এসব এন্টিসেপ্টিক মলম ত্বকের ক্ষতে জীবাণুর আক্রমণ রোধ করার জন্য চিকিৎসকরা ব্যবহার করে থাকেন। এছাড়াও বিভিন্ন ওষুধ তৈরির প্রক্রিয়ায় ক্রোমিক এসিড নিষ্ক্রিয় উপাদান হিসেবে ব্যবহার করা হয়।


সাবধানতা

আমরা সকলেই জানি যে, যে কোন রাসায়নিক উপাদানই অত্যন্ত সাবধানতার সাথে ব্যবহার করা উচিত। আর জন সাধারনের ব্যবহার উপযোগী না হলে সেই রাসায়নিক বস্তু অভিজ্ঞ কারো সাহায্য ছাড়া ব্যবহার না করাই শ্রেয়। অন্যথায় ছোট বড় যে কোন ধরনের বিপদ হতে পারে।

ক্রোমিক এসিড খুবই শক্তিশালী একটি অক্সিডাইজার এবং কিছু সহজে অক্সিডাইজ হয়ে যায়। এটি জৈব পদার্থের সাথে মিশ্রিত হলে হিংসাত্মক প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারে, যা বিস্ফোরণ বা আগুন জ্বালানোর কারণ হতে পারে। এই এসিড দ্বারা সৃষ্ট কোনো পোড়া ক্ষতের ক্ষেত্রে সাধারণত সোডিয়াম থায়োসালফেটের পাতলা দ্রবণ দিয়ে চিকিৎসা করা হয়।


বিভিন্ন গবেষণায় মানুষ ছাড়া অন্যান্য কিছু প্রাণীর দেহে ক্রোমিক এসিডের সংস্পর্শে ফুসফুসের ক্যান্সার রোগের সংক্রমণ হওয়ার প্রমাণ পাওয়া গেছে। ফলে ক্রোমিক এসিড থেকে ক্যান্সার হওয়ার ঝুকি থেকে মানুষকেও পুরোপুরি নিরাপদ বলা যায় না । ক্রোমিক এসিডের সংস্পর্শ গর্ভবতী মাতৃদেহের ভেতর উন্নয়নশীল ভ্রূণের ক্ষতি করতে পারে।


ক্রোমিক এসিড ত্বকের সংস্পর্শে আসলে অ্যালার্জির কারণ হতে পারে, যা থেকে র‍্যাশ ও চুলকানি হতে পারে। এর থেকে ক্ষতও হতে পারে, যা মারাত্বক আকার ধারন করলে রক্তপাত, স্রাব বা ক্রাস্টও তৈরি হতে পারে। দীর্ঘ সময় ক্রোমিক এসিডের সংস্পর্শে থাকতে থাকলে দেহের বিভিন্ন স্থানে ক্যামিকাল বার্ন সৃষ্টি হতে পারে। চোখের সংস্পর্শে আসলে চোখে জ্বালা পোড়া ও দৃষ্টি শক্তির ক্ষতিও হতে পারে। ক্রোমিক এসিড নিশ্বাসের সাথে প্রবেশ করলে শ্বাস-প্রশ্বাসে সমস্যা, নাক, গলা এবং ফুসফুসে প্রদাহ হতে পারে যার ফলে কাশি, শ্বাসকষ্ট ইত্যাদি সমস্যা তৈরি হতে পারে। নাকের সংবেদনশীল মিউকাস ঝিল্লির জন্য এটি খুবই ক্ষতিকর। দীর্ঘ সময় বা অতিরিক্ত সংস্পর্শে হাড়ে পর্যন্ত ক্ষত সৃষ্টি করতে সক্ষম ক্রোমিক এসিড। এমনকি কিডনিতেও ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে। স্বল্প মাত্রার সংস্পর্শে হওয়া এলার্জি, র‍্যাশ বা চুলকানির সমস্যা প্রাথমিক চিকিৎসাতে ভালো হলেও, দীর্ঘ মেয়াদি সংস্পর্শে হওয়া দেহের বাইরের ও অভ্যন্তরীণ ক্ষত সারানো সময়সাপেক্ষ ও ব্যায়বহুল হতে পারে। সুতরাং,  যারা বিভিন্ন কারনে ক্রোমিক এসিডের সংস্পর্শে আসতে বাধ্য হন, তাদের উচিত নিয়মিত ডাক্তারের পরামর্শ মেনে চলা ও কিডনি, ফুসফুস ইত্যাদির পরীক্ষা নিরিক্ষার মাধ্যমে নিযের স্বাস্থ্য সম্পর্কে নিশ্চিত থাকা।

Recent Post